ডলার সংকটের পরিস্থিতিতে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে বিলাস পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কিছুটা কমেছে বটে। তবে ডলার সংকট কমেনি, বরং বেড়েছে। এ কারণে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমতে শুরু করেছে। ফলে শিল্প খাতে উৎপাদন কমার প্রবণতা শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই সেপ্টেম্বরে শিল্প খাতে কাঁচামালভেদে আমদানি ৩ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হচ্ছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, বস্ত্র, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, প্রাণিখাদ্য, জাহাজ নির্মাণ, সমুদ্রগামী জাহাজ, ওষুধ, রাসায়নিক ইত্যাদি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। তবে আমদানি প্রতিস্থাপকশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমার কারণ দুটি; এক. ডলার সংকট, দুই. চাহিদা কম। তা ছাড়া আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। কাঁচামাল আমদানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শিল্প খাতে উৎপাদন কমতে থাকবে। আর ধারাবাহিকভাবে এই প্রবণতা কর্মসংস্থান ও জিডিপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিতে দুষ্টচক্র তৈরির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শক্ত হাতে জরুরি ভিত্তিতে এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। অর্থ পাচার ও হুন্ডি রোধে কঠোর পদক্ষেপ এবং প্রবাসী আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, ডলার সংকট আরও তীব্র হলে অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
গত জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ৩ লাখ ৫৯ হাজার টন তুলা আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৪ লাখ ৭০ হাজার টনের চেয়ে ১ লাখ ১১ হাজার টন বা ২৩ শতাংশ কম। তবে মূল্য বিবেচনায় তুলা আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে তুলা আমদানির শুল্কায়ন মূল্য ছিল ৮৫ কোটি ডলার। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহসভাপতি মো. সালেউদ জামান খাঁন বলেন, বছরের প্রথমার্ধে গ্যাস সংকট ছিল। ক্রয়াদেশ কম থাকায় চাহিদাও সেভাবে ছিল না। এর ওপর আমদানিকারকেরা ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা পড়েন। এসব কারণে তুলা আমদানি কমেছে। অবশ্য জুলাইয়ের পর ক্রয়াদেশ বাড়ছে। এখন গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে সামনের দিনগুলোতে তুলা আমদানি বাড়বে। সেবা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি খাত সমুদ্রগামী জাহাজে পণ্য পরিবহন। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছিল ১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ৬৪২ কোটি টাকায় নেমে আসে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ঢেউটিন ও ইলেকট্রনিকসশিল্পে ব্যবহৃত ইস্পাতের পাত প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কাঁচামাল হট রোলড কয়েলের আমদানি কমে ১ লাখ ৯৩ হাজার টনে নেমেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার টনের চেয়ে ২৯ শতাংশ কম। দামের হিসাবে আমদানি ব্যয় ৪৭ শতাংশ কমে হয়েছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রধান দুটি কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১৮ হাজার ৬৬৮ টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ২৪ হাজার টনের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। দামের হিসাবে আমদানি কমেছে ৩৯ শতাংশ। রাসায়নিক ও সহযোগী শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য আমদানির পরিমাণে ২১ শতাংশ ও দামে প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। এই খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি হয়েছে ২২ লাখ ৪০ হাজার টন, যা চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টন।
আর আমদানি মূল্য ২৫২ কোটি ডলার থেকে ১৫২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। রাসায়নিক ও সহযোগী শিল্প ক্যাটাগরিতে জৈব ও অজৈব রাসায়নিক, ওষুধ, প্রসাধন, সার ইত্যাদি পণ্য রয়েছে। প্লাস্টিক খাতে আমদানি গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন থেকে কমে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টনে নেমেছে। আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ। পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি অবশ্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। এই খাতে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন, যা গত অর্থবছরে ছিল ১৩ লাখ ৯ হাজার টন। ভোগ্যপণ্যশিল্পে শুধু গম আমদানি বেড়েছে। অপরিশোধিত চিনি, সয়াবিন তেল ও পাম তেল এই তিনটির আমদানি কমেছে।