রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের। তাই সরকার যে কোনো উপায়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে চায়। আর সেই রাজস্ব আয় বাড়ানোর অস্ত্র হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটকেই বেছে নিয়েছে সরকার। ফলে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে করের আধিক্য দেখা যেতে যারে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা, বেড়ে যেতে পারে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সংগ্রহ করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। অন্যদিকে কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
ফলে বড় অঙ্কের রাজস্ব সংগ্রহ করতে সর্বত্রই কর বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে কর ব্যতীত প্রাপ্তির নানা খাতের কর।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকেও বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
সেজন্যই সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আইএমএফ শুধু রাজস্ব আয় বৃদ্ধির চাপই দেয়নি, কোন কোন খাত থেকে কর বৃদ্ধি করা যায় তারও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। সেই সঙ্গে কর ছাড়ের ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি তুলেছে। ফলে আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করেই সরকার আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির এক মেগা কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে। ফলে আগামী বছরের বাজেটকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বাজেট বললেও ভুল হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর ॥ সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এক্ষেত্রে আয়কর হচ্ছে প্রতক্ষ কর এবং ভ্যাট ও শুল্ক হচ্ছে পরোক্ষ কর।
শুল্কের মধ্যে রয়েছে আবার আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য সরকার আগামী বাজেটে আয়কর যেমন বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে, তেমনি আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
বাড়ছে বিত্তশালীদের কর ॥ বর্তমান বাজেটে মানুষের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা; অর্থাৎ কেউ যদি বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি আয় করেন, তাকে কর দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। ২৬ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি প্রায় ২ অঙ্কের ঘরে। আবার মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম টানা ২৭ মাস।
অর্থনীতির পরিভাষায় মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম হলে সেটি অর্থনীতির বড় সংকটের ইঙ্গিতই দেয়। মূল্যস্ফীতির এই বাজারে সংসার খরচ মিটিয়ে সরকারকে কর দেওয়া যে কোনো নাগরিকের পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভবই বটে। এই দুর্বিষহ অবস্থা সত্ত্বেও রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ থেকে আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না।
প্রত্যক্ত করের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে আগামী বাজেটে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। এটিকে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানোর তথাকথিত উদ্যোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র। এটি করতে পারলে কর বিভাগ বাড়তি অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে পারবে।
কালো টাকায় ঢালাও ছাড় ॥ আয়কর থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামী অর্থবছরে আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসতে পারে। এই সুযোগ দেওয়া হতে পারে এক বছরের জন্য।
দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এই সুযোগ বাতিল করা হয়। এর পরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ এই সুযোগ নেয়নি। ফলে কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এক বছর বিরতি দিয়ে আবার আগামী অর্থবছরে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে জানা গেছে।
এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ১৫ বছরে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা সাদা হয়। আওয়ামী লীগের শেষ তিন মেয়াদে (২০০৯-২৩) প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বৈধ হয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। ওই সময়ে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার করদাতা কালো টাকা সাদা করেছিলেন।
সবমিলিয়ে আগামী বাজেটে শুধু আয়কর থেকেই অন্তত ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। উঠে যাচ্ছে ৩৩৫ নিত্যপণ্যের শুল্কছাড় ॥ এক সময় রাজস্ব আয়ের বড় খাত ছিল আমদানি শুল্ক। উদারনীতি গ্রহণের ফলে বাধ্যতামূলকভাবে আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক কমিয়ে দিতে হয়েছে অতীতের সরকারগুলোকে। ফলে আমদানি থেকে সংগৃহীত শুল্ক আদায় এখন কমে গেছে। তার ওপর ছিল নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় সুবিধা। কিন্তু আইএমএফের চাপে আগামী বাজেটে আমদানি করা শিল্পের কাঁচামালসহ ৩৩৫টি নিত্যপণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্কছাড় সুবিধা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ কোনো পণ্যই আর শুল্কমুক্ত থাকছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাতের অন্তত ৩৩৫ আমদানি পণ্যে ন্যূনতম ১ শতাংশ হারে শুল্ক বসানো হচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছে অপরিশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চাল, গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী বীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইন্স্যুলিন, ওষুধ ও শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সার এবং বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ।
আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এনবিআর। ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে রাজস্ব বিভাগ। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত স্তরটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।
সেখানে ১০-৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আগের মতোই তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসবে। ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত তিন হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসতে পারে। ১-৫ কোটি টাকা পর্যন্ত স্তরটিও ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে ১-২ কোটি টাকা পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা এবং ২-৫ কোটি পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা করা হতে পারে।
এখন ১-৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসে। কারও ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে। এখন এই স্তরে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়।
অন্যদিকে সরকার ২৮টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর অর্ধেক করে ১ শতাংশ করতে যাচ্ছে। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে হিমশিম খাওয়া ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মোটর, ছোলা, মসুর, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলের সরবরাহের ওপর বর্তমান ২ শতাংশের পরিবর্তে উৎসে ১ শতাংশ কর কাটা হবে বলে জানান তারা।
অন্যদিকে সরকার আড়াই কেজি পর্যন্ত ওজনের প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধ আমদানিতে মোট করহার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে গুঁড়া দুধের বাল্ক আমদানিকারকদের জন্য মোট করহার ৩৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বাজেট পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় খাদ্য ও খাদ্য-সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক বা কর না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ধাপে ধাপে বাড়ছে ভ্যাট ॥ বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবাভেদে ২, ৩, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। অন্যদিকে ভ্যাটের অভিন্ন হারের মতো কয়েকটি খাতে ভ্যাট অব্যাহতিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইনে একটি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাটহার (১৫ শতাংশ) ছিল। নানা কারণে সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। এজন্য বর্তমানে একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই হার যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভ্যাটহার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাটহার আরোপ করা হবে।
অনেক পণ্যে ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ করায় এর প্রভাব পড়বে বাজারে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি ভ্যাট ও শুল্কের দায় ভোক্তাকেই বহন করতে হবে। এ ছাড়া আসন্ন বাজেটে বাড়তে যাচ্ছে ব্যাংকে রাখা অর্থের ওপর আবগারি শুল্কও। বাড়বে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্কও। সব মিলিয়ে বাড়তি করের চাপে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
আসন্ন বাজেটে স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ ও ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা সংকুচিত করে আনা এবং সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ও মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে।
অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের ১ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কারোপ করা হতে পারে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে মোবাইল সেবার দাম বাড়তে পারে। এতে ভোক্তা ১০০ টাকা রিচার্জ করে ৬৯ দশমিক ৩৫ টাকার কথা বলতে পারবেন। এতদিন মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারতেন।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ক্যাপিটাল গেইন কর আরোপের সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। এই হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে পার্কে ঘোরার খরচ বাড়বে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ সরবরাহ পর্যায়ে এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
ঢাকাবাসীর সবচেয়ে নিরাপদ ও জনপ্রিয় বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেট্রোরেল। ভাড়া তুলনামূলক বেশি হলেও যাত্রীদের চাপ দেখে এ সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসাচ্ছে এনবিআর; অর্থাৎ ১০০ টাকা মেট্রো ভাড়ায় যাত্রীদের দিতে হবে আরও ১৫ টাকা। সূত্র বলছে, মেট্রোরেলের সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ না করার আবেদন জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সচিব।
তবে সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে ভ্যাট আরোপে অনড় অবস্থানে রয়েছে এনবিআর। তারা বলছে, ১ জুলাই থেকেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে।
আগামী বাজেটে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট জাল সম্প্রসারণ করা হবে। বিশেষ করে ইএফডি মেশিন স্থাপনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া শনাক্ত করা হবে নতুন করদাতাও। নতুন করদাতাদের করজালে আনতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এ ছাড়া ২০ লাখ টাকা বা তার ঊর্ধ্বে মূসক পরিশোধে ই-চালান বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আগে সেটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া আয়কর আইন-২০২৩ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো, আদায় বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নয়ন করা করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
এ ছাড়া এলইডি বাল্ব, টিউব লাইট, বিভিন্ন ধরনের জুস, ম্যাঙ্গো বার, রোলিং পেপার, নিরাপত্তা সেবা, নিলাম সেবা, রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারসহ ১৩টিরও বেশি পণ্য ও পরিষেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ করা হবে।
এ ছাড়া আগামী ৩০ জুন শেষ হতে চলা চলতি অর্থবছরে এসি উৎপাদনে যে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে তা প্রত্যাহার করা হবে নতুন অর্থবছরে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় আসতে পারে এই পণ্য।
রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের সিম কার্ড বিক্রির ওপরও কর বাড়ানো হবে, যা বর্তমানের ২০০ থেকে বেড়ে হতে পারে ৩০০ টাকা। কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসলেও, আগামী অর্থবছর থেকে এসি উৎপাদনে ভ্যাট আরোপের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। একইভাবে ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫-১৫ শতাংশ করা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, আগামী অর্থবছর থেকে নিরাপত্তা সেবা প্রদানকারী থার্ড পার্টি কোম্পানিগুলোর সেবা নেওয়া এবং নিলামে অংশ নেওয়ার ব্যয় আরও বাড়বে। উভয় পরিষেবার জন্যই ভ্যাটের হার বিদ্যমান ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে পারে সরকার।
কর ব্যতীত প্রাপ্তি ॥ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাত থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। এ খাত থেকে ৫৮ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা সংগ্রহের অতীত রেকর্ড রয়েছে সরকারের। ফলে শেষ পর্যন্ত এ খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে।
এ খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য সরকার আগামী বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারামূল্যও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হবে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)। মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, সেগুলোর পরিমাণও বাড়ানো হতে পারে।
এ ছাড়া উড়ালসড়ক, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুলও বাড়ানো হতে পারে। এভাবে সরকার মোট ৫৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে চায়, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে মাশুল বৃদ্ধির কোনো কথা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করা হবে না। শুধু টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি উল্লেখ থাকবে।
জানা যায়, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো প্রজ্ঞাপন জারি করে এসব মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে। যেসব মাশুলে সরকার কয়েক বছর ধরে হাত দেয়নি, সেগুলোর ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আগে। কোনো কোনো মাশুল কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকেই। কোনোটি আবার প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী কার্যকর হবে।
করবহির্ভূত প্রাপ্তি থেকে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ১০টি বড় উৎস আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক ও বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। এভাবে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা হলো ৯ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা পাওয়া।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা একটু বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি হতে পারে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে সুদ বাবদ প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকার, সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পাওয়া যায়। প্রশাসনিক মাশুল বাবদ ধরা হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা।
আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থি বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতি বছর কিছু অর্থ আয় করে থাকে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আয় ধরা হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকা।
সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বিমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। এসব সেবার বিপরীতে সরকার আগামী অর্থবছরে ৯ হাজার কোটি টাকা আয় নির্ধারণ করতে পারে।
হাট-ঘাট ভাড়া ও ইজারা দিয়ে সরকার আগামী অর্থবছরে হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি আয় করতে চায়। টোল ও লেভি থেকে আসতে পারে আরও হাজার কোটি টাকার বেশি। সঙ্গে সঙ্গে আছে মূলধন রাজস্ব। পুরনো গাড়ি বা আসবাবপত্র নিলামে বিক্রির অর্থ মূলধন রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আয় ধরা হচ্ছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।