ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য সব মিলিয়ে আবেদন জমা পড়েছে ৫২টি। আরও চারটি প্রতিষ্ঠান টাকা জমা দিয়েছে, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করবে এবং তারপর তা পরিচালনা পর্ষদের কাছে উপস্থাপন করবে। তবে এখনো ঠিক হয়নি, কয়টি লাইসেন্স দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেছেন, ৫২টি আবেদন যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগবে। অর্থাৎ কবে নাগাদ যোগ্য আবেদনগুলো পরিচালনা পর্ষদের কাছে উত্থাপিত হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তেমনই জানা যাচ্ছে না, কবে নাগাদ শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল ব্যাংক আলোর মুখ দেখবে।
তবে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহ যে ব্যাপক, তা আবেদনের সংখ্যা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যে ৫২টি আবেদন জমা পড়েছে, তার সব কটিই যৌথ উদ্যোগে করা আবেদন। কোনো কোনো আবেদনে ১০টি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সুতরাং এটা বলা যায়, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে চেষ্টা করছে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান।
ডিজিটাল ব্যাংক কী
ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। তবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি হবে স্থাপনাবিহীন। অর্থাৎ এই ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেবে না। এর নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না। সব সেবাই হবে অ্যাপ-নির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে।
একটি ডিজিটাল ব্যাংকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা মিলবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চ্যুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে। তবে লেনদেনের জন্য কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। বড় ও মাঝারি শিল্পেও কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।
নীতিমালা
বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরপর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তা অনুমোদন করে। ওই নীতিমালার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করে। এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকবে না। মুঠোফোন অথবা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেই গ্রাহকদের ব্যাংক সেবা দেওয়া হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী চলবে এই ডিজিটাল ব্যাংক।
ব্যাংক স্থাপনের শর্ত
বাংলাদেশে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক করতে প্রয়োজন হয় ৫০০ কোটি টাকার মূলধন। তবে একেকটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। এ ধরনের ব্যাংকের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা মূলধন জোগান দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা শেয়ার ছাড়তে হবে। আইপিওর পরিমাণ হতে হবে স্পনসরের প্রাথমিক অবদানের ন্যূনতম পরিমাণের সমান।
এ ছাড়া শর্তে আরও বলা হয়েছে, এই ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ কতজন পরিচালক হতে পারবেন, তা ঠিক হবে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, রেগুলেশন, গাইডলাইন, সার্কুলার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কারা আবেদন করেছে
ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে যারা আবেদন জমা দিয়েছে, তাদের সবার নাম এখনো জানা যায়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তা প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম জানা গেছে, যারা ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য আবেদন করেছে।
তাদের মধ্যে রয়েছে ‘ডিজি টেন পিএলসি’ নামে ১০টি ব্যাংকের জোট। এসব ব্যাংক সব মিলিয়ে ১২৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে। এই জোটে রয়েছে সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত ‘বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক’-এর সঙ্গে বর্তমান উদ্যোক্তা ব্র্যাক ব্যাংকের পাশাপাশি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানি ইন মোশন এলএলসি, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, অ্যান্ট গ্রুপ ও সফটব্যাংক ভিশন ফান্ড। ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’ গঠনের জন্যও আবেদন করেছে নগদের বর্তমান ও অন্য কিছু উদ্যোক্তা। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত তিন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, রূপালী, অগ্রণী মিলে জোটবদ্ধভাবে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের আবেদন করেছে। আবেদন জমা দিয়েছে মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংক ও তাদের মূল কোম্পানি ভিওন।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী কোম্পানি উপায়ের নেতৃত্বে একটি জোট আবেদন করেছে। নাম ঠিক করা হয়েছে ‘উপায় ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’। এই জোটে আছে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসি ও মেঘনা। সঙ্গে রয়েছে ইউসিবির উদ্যোক্তাদের কোম্পানি আরামিট, যারা মূলত ঢেউ শিট উৎপাদন করে। জোটে আরও আছে ইউসিবির উদ্যোক্তাদের কোম্পানি নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদানকারী কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস। জেনেক্স ইনফোসিস হলো এনআরবিসির কয়েকজন উদ্যোক্তার কোম্পানি। এ ছাড়া ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক করার আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ‘পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক স্থাপন করতে চায়।
কেন এত আগ্রহ
বর্তমানে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক আছে ৬১টি। তাদের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতের ব্যাংক। এখন পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হয়েছে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে স্টার্টআপ কোম্পানি, মোবাইল অপারেটর, গ্যাস পাম্প কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি, ঢেউ শিট উৎপাদনকারী কোম্পানিও। আবার বিদেশি আর্থিক প্রযুক্তি কোম্পানিও আবেদন জমা দিয়েছে।
যে ১০ ব্যাংক মিলে ডিজিটাল ব্যাংক করতে চায়, তাদের একটি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। একটি প্রথাগত ব্যাংক পরিচালনা করেও তারা কেন আলাদা ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন করতে চায়, তা জানতে চাইলে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে এমন জনগোষ্ঠী আছে, যাঁরা অল্প অর্থের আমানত রাখতে চান কিংবা ছোট ঋণ চান। তাঁদের প্রথাগত ব্যাংকিং সুবিধায় নিয়ে আসার একটি বড় সমস্যা হলো, কাজটি করতে খরচ বেশি। তবে কম খরচে কাজটি করা সম্ভব একটি ডিজিটাল ব্যাংকের পক্ষে।
‘এই যে লাস্ট মাইল অতিক্রম করা, যা আমরা এখন পারছি না, আমাদের উদ্দেশ্য হলো, তা অতিক্রম করা। ডিজিটাল প্রতিবেশ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, প্রথাগত ব্যাংকিং করে আমরা তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছি না। সে জন্যই আমরা ডিজিটাল ব্যাংক করতে চাই।’
তাঁরা আলাদাভাবে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন করতে চান। কারণ, প্রথাগত ব্যাংকারদের দিয়ে ডিজিটাল সেবা দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। ‘আমরা দেখেছি, আমরা সবাই একইভাবে ডিজিটালি চিন্তা করতে পারি না,’ প্রথাগত ব্যাংকারদের মানসিক কাঠামো নিয়ে বলেন এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অন্যদিকে ‘পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার আগ্রহ জানিয়ে ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পাঠাও বলেছে, ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন পেলে তাতে অনেক তরুণ উপকৃত হবেন।
সতর্ক হওয়া দরকার
ডিজিটাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক কারা হবে, কাদের হাতে মালিকানা যাবে, কীভাবে এগুলো পরিচালিত হবে—এসব বিষয় নিয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রেখে মানুষ টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ‘এমন একটি সময়ে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া কতটা সময়োপযোগী হবে, এটা বিবেচনা করতে হবে। যাকেতাকে এসব ব্যাংকের লাইসেন্স দিলে বিপর্যয় ঘটবে,’ প্রথম আলোকে বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সাবেক শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে প্রয়োজন দেশের ব্যাংকগুলোকে ঠিকঠাক করে সঠিক পথে নিয়ে আসা। এর জন্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ দরকার ছিল, কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে উদ্ভাবনের নামে ঠিক কাজটি করা হচ্ছে কি না।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই হচ্ছে কি না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।’
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সঠিক জনবল খুঁজে পাওয়া। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল ব্যাংকের ব্যাপারে জনসচেতনতা, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিপণন চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।