ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাক হোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজেরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী।
কমিটি আরও জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। কেবল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গতকাল দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। কমিটির প্রধান ছিলেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাঁর নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। তিনি বলেন, এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার একটি বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সাল ও এরপরে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দখলে নেয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। একই সময়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আগামী দিনে খেলাপি ঋণের অর্ধেক বা আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে এস আলম, সাইফুজ্জামানসহ বড় কয়েকটি গ্রুপ ও ব্যবসায়ীর।
জিম্মি ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
শ্বেতপত্রে ব্যাংক খাতের নানা সূচক তুলে ধরে বলা হয়, রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাংক আইন পরিবর্তন হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নীতিমালাও পরিবর্তন করা হয়েছে। স্বতন্ত্র পরিচালকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি। এমনকি অভ্যন্তরীণ ও বহির্নিরীক্ষক যথাযথ ভূমিকা রাখেনি। নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাজনীতিক বিবেচনায়, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জিম্মি করে ফেলা হয়। নতুন সরকার গঠিত হওয়ায় ব্যাংক খাতকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে রক্ষা করার সুযোগ হয়েছে। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে নতুন কোনো স্বজনতোষী পুঁজিবাদ যাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ১০টি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। এর মধ্যে ২টি সরকারি ব্যাংক ও ৮টি বেসরকারি ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকের বেশির ভাগ শরিয়াহভিত্তিক। এই ১০ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুরো খাতের ৩৩ শতাংশ ঋণ, আর ৩২ শতাংশ আমানত। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, এসব ব্যাংক কারিগরিভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং তাদের তারল্য নেই। তবে তা তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়নি।
খেলাপি ঋণ ৩০% পৌঁছাবে
ব্যাংক খাতে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা, স্পেশাল মেনশন হিসেবে ছিল ৩৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা, আদালতের স্থগিতাদেশে খেলাপিমুক্ত ছিল ৭৬ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার ঋণ। ফলে জুন মাস শেষে মোট দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ফলে খেলাপি ঋণ ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে।
শ্বেতপত্র হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে, এখন যা সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫ শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ হয়ে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। খেলাপি আগেই হয়ে আছে, এখন তা হিসাবে আসবে। এটা কমিয়ে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তদারকি জোরদার করতে হবে, যে কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পরীক্ষা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে করা হচ্ছে। ১১ ডিসেম্বর এই কাজ শুরু হবে। প্রথমে ১২টি ব্যাংক ও পরে ২০টি ব্যাংকে নিরীক্ষা করা হবে। এতে তাদের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এরপর এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেবে, তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে গ্রাহক আস্থা ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আইন করা হচ্ছে। পাচারের টাকা ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।’