ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) আওতায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ মোট ১৪টি দেশ শনিবার ঘোষণা দিয়েছে, এ-বিষয়ক আলোচনায় প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
টিএনএনের সূত্রে ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৪টি দেশ চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পরস্পরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করবে, যেমন টিকা ও ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামালের স্বল্পতা মোকাবিলা করা। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেন অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করা না হয়, তাও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ ও পণ্য জাহাজীকরণের ক্ষেত্রেও দেশগুলো পরস্পরের কাছাকাছি আসবে। বলা হয়েছে, আইপিইএফ অংশীদারদের মধ্যে জরুরি সময়ের জন্য নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। সরবরাহব্যবস্থা সচল রাখা ও দক্ষ মানবসম্পদ নিশ্চিত করতেও কাজ করবে এই নেটওয়ার্ক, যা করা হবে বিনিয়োগ সংগ্রহে পরস্পরকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি।
এই ঐকমত্যের পূর্ণাঙ্গ খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হলেও টিএনএনের সূত্রে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, সরবরাহব্যবস্থায় শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এতে অবশ্য সামনের দিনগুলোতে একধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে।
এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০২২ সালের দ্বিতীয় ভাগে। মূলত চারটি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এই গোষ্ঠী আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে আছে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি, ন্যায্য বাণিজ্য ও অর্থনীতি। তবে ভারত শেষোক্ত ক্ষেত্রে সংযুক্ত নয়।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক অংশীদারি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ। এর মাধ্যমে তারা এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, যেসব দেশের সঙ্গে একসময় চীনের সুসম্পর্ক থাকলেও এখন উভয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বলা হয়েছে, আইপিইএফ সদস্যরা প্রস্তাবিত চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, সে জন্য দরকার হলে অভ্যন্তরীণ আলোচনাসহ আইনি পর্যালোচনাও করা হবে। এরপর সব দেশের সংসদে তা পাস ও গৃহীত হবে। এতে বোঝা যাচ্ছে, চুক্তির বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বাণিজ্য যুদ্ধ ও কোভিডের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তিগুলো চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে টানা প্রায় তিন বছর চীনের শূন্য কোভিড নীতি পশ্চিমাদের এই নীতির পালে হাওয়া দিয়েছে।
সরবরাহ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বরং ভারতের জন্য অনুকূল হয়েছে। চীনের শূন্য কোভিড নীতির কারণে অনেক কোম্পানি চীন নির্ভরশীলতা কমাতে শুরু করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানির গৃহীত চায়না প্লাস ওয়ান কৌশলের বড় সুবিধাভোগী হতে পারে ভারত ও ভিয়েতনাম। এরই মধ্যে অ্যাপলের মূল তিন তাইওয়ানিজ সরবরাহকারীকে প্রণোদনা দিচ্ছে মোদি সরকার। ফলে ভারতে আইফোনের উৎপাদন অনেক বেড়েছে।
চীন ও জার্মানির মতো উৎপাদনে সক্ষমতার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই নতুন উৎপাদনক্ষেত্র খোঁজা শুরু হয়েছে। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল রাখাই গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক মরগান স্ট্যানলির পূর্বাভাস, চলতি দশকে ভারতের বার্ষিক উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এমন জায়গায় পৌঁছাবে যে বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদনকারীদের কাতারে চলে যেতে পারে দেশটি।
দ্য ইকোনমিস্টের তথ্যানুসারে, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে ভারত সরকার আগামী কয়েক বছরে অনেকগুলো শিল্প খাতে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি প্রণোদনা দেবে। এর মধ্যে কিছু অর্থ ব্যয় হবে উইস্ট্রন করপোরেশনের মুঠোফোন সেট আর হন হাই প্রেসিশন ইন্ডাস্ট্রির চিপ উৎপাদন ও রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সৌরবিদ্যুতের প্যানেল তৈরিতে। এর পরের ধাপ হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উৎপাদকে পরিণত হতে উৎপাদনে সক্ষমতা বা ব্যাপ্তি বাড়ানো।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবেই ধাপে ধাপে চীনের বিকল্প হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছে ভারত। তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির এই পালাবদল ঘটছে পশ্চিমাদের নেতৃত্বে। এশিয়ার ১৪টি দেশকে এভাবে এককাতারে নিয়ে আসা সেই চেষ্টারই অংশবিশেষ।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভিত্তিক টিটিপি চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এরপর কার্যত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। আইপিইএফের মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিজের অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত চীনের নেতৃত্বে গঠিত রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) চুক্তির পাল্টা হিসাবেই যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ।