এক অর্থবছরের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় তিন হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যা বিদায়ি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) প্রাথমিক হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ৫৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা কমবেশি হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে এই ঋণের অঙ্ক আরও বেশি হবে। কারণ, সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও খেলাপি দেখানোর পক্ষে সংস্থাটি।
জানা যায়, বর্তমানে দেশের আদালতগুলোয়ই খেলাপি ঋণের প্রায় পৌনে এক লাখ মামলা বিচারাধীন। সেখানে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। পাশাপাশি একই সময়ে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। অর্থবছরের শুরুতে শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত তা অর্জন হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি বৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, সংস্থাটি বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ ইস্যুর বিপরীতে যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো হচ্ছে-খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা। কিন্তু এখনো খেলাপি ঋণের হার ২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ বিরাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কোনো লাভ নেই। এটি অর্জনের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটি দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. আনিসুর রহমান জানান, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হচ্ছে। কেস টু কেস ধরে খেলাপিদের কাছ থেকে আদায়ের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আশা করি, এতে কার্যকর ফলও পাওয়া যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের এপিএ (কর্মসম্পাদন চুক্তি) হয়েছে। আশা করছি তা অর্জন সম্ভব হবে। একই ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং আদায়ে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কঠোর অভিযান শুরু করেছে। বিশেষ করে এই ব্যাংকের স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিরা যাতে বিদেশে পালাতে না পারে, এজন্য ইমিগ্রেশনে তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শাখাগুলোকে। এরই আলোকে আদালতের অনুমতি নিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন ঋণখেলাপির পাসপোর্ট জমা পড়েছে ইমিগ্রেশনে। অন্য খেলাপিদের পাসপোর্টও পর্যায়ক্রমে জমা দেওয়া হবে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে আরও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমান বেসিক ব্যাংক খেলাপি ঋণের স্থিতি ৭ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা এবং খেলাপিদের কাছ থেকে ১৬০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। সমাপ্ত অর্থবছরে বেসিক ব্যাংক ১৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছু আইন থাকলেও এসব প্রয়োগের অভাব রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংকিং খাতেও খেলাপিদের বিরুদ্ধে কখনোই খুব কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং তারা বরাবর নানারকমের সুবিধা পেয়েছেন। যে কারণে খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না। তবে ভিয়েতনাম, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশ আইনের শক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ অনেক কমিয়ে এনেছে।