বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন করে আর এক টাকাও ঋণ নিচ্ছে না সরকার। উল্টো আগের ঋণ পরিশোধ করছে। এতে করে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরকারের ঋণ কমেছে ১৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ২৮ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে দুই মাসে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার বিবেচনায় টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। আগেও এমন অবস্থান থাকলেও গত সরকারের শেষ দিকে তথ্য গোপন করে তিন মাসে প্রায় ৪১ হাজার টাকা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘ওভারড্রাফট’ হিসেবে সরকারকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা থাকলেও এক ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উপায়ে দেওয়া টাকা সরকারের ঋণের প্রতিবেদনে দেখানো হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের দায় পরিশোধ করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যা ভালো পদক্ষেপ। আবার আগের মতো তথ্য নিয়ে লুকোচুরি হচ্ছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতদিন এ ধারা ধরে রাখতে পারবে, তা দেখার বিষয়। কেননা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের বড় অঙ্কের বকেয়া হয়ে আছে। এসব তো পরিশোধ করতেই হবে। বকেয়া নিষ্পত্তি না করলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। ফলে এখনই বলা যাবে না যে, সব ঠিক হয়ে গেছে। এজন্য আরও সময় দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক আগে থেকেই টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার কথা বলে আসছিল। সর্বশেষ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণাত্মক দেখানো হলেও শেষ তিন মাসে আসলে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়। মূল্যস্ফীতি না কমার পেছনে যার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই মূল্যস্ফীতি দশ শতাংশের আশপাশে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অন্যতম নীতি হলো ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন এবং অপচয় রোধ করা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ যাতে খুব বেশি না বাড়ে, সেদিকেও বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। তিনি জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এখন যে ঋণ আসছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের উচ্চ সুদ এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এখানে টাকা খাটাচ্ছে। অনেকেই এখন সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানত ভেঙে এনে এখানে রাখছে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে আসা অর্থে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে গত আগস্ট শেষে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। গত জুন শেষে যা ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সরকারের এ ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে গত জুনের তুলনায় ২৮ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা বেড়ে তিন লাখ ৪৭ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে গত জুনের এক লাখ ৫৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা থেকে কমে এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকায় নেমেছে। মূলত ওভারড্রাফট খাতে দেওয়া বাড়তি টাকা সমন্বয় করছে সরকার। গত জুন শেষে এ খাতে যেখানে ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ছিল। আগস্ট শেষে তা কমে ২৯ হাজার ৩৫১ কোটি টাকায় নেমেছে।