টাকার সংকটে পড়া সরকার সার ও বিদ্যুৎ খাতের দেনা মেটাতে বাজারে বন্ড ছাড়ছে। এই বন্ড কিনবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিপরীতে সুদ পাবে তারা। বন্ড হলো একধরনের আর্থিক পণ্য, যা বিক্রি করে সরকার ও বেসরকারি খাত দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিতে পারে। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সার ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। তাই এবার বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় বন্ড ছাড়া হবে সারের পাওনা পরিশোধ বাবদ। এ জন্য অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ কয়েক দিন থেকেই কাজ করছে। আর বিদ্যুতের বন্ড ছাড়া হবে পরের দফায়। সেটা হতে পারে ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। সরকারি হিসাবে সার ও বিদ্যুতে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থার পাওনা প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি ১৪ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। সারে বকেয়া ১২ হাজার কোটি টাকা।
আমদানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ততটা ভালো নয়। তাই রাজস্ব আদায় কম। এ কারণে নগদ টাকায় ভর্তুকির দায় পরিশোধের বদলে বন্ড ছাড়তে হচ্ছে। কত বছর মেয়াদি বন্ড ছাড়া হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। দেশে মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে আমদানি খাতে রাজস্ব আদায় কমেছে। স্থানীয় উৎস থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আদায়েও গতি কম। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এ সময়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক সংকটে থাকা সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া শুরু করেছিল। তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সে পথ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরে এসেছে। এখন সরকার হাঁটছে বন্ড ছাড়ার পথে। অর্থ বিভাগ আজ বুধবার বা আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যেই এই বিশেষ বন্ড ছেড়ে সার ও বিদ্যুৎ খাতে দায় মেটানোর প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। যদিও তা কার্যকর হতে আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
আমদানিকারক ও উৎপাদকের কাছ থেকে যে দামে সার কেনা হয়, তার চেয়ে অনেক কম দামে বেচা হয় বাজারে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও তা–ই। মাঝখানের পার্থক্যটুকু ভর্তুকি দেয় সরকার। কয়েক মাস ধরে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ও সারে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।
সারে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) দেওয়ার কারণে এ খাতে সরকারের বিপুল ব্যয় করতে হচ্ছে। সূত্র জানায়, বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গত মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে পাওনার তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে অর্থ বিভাগ। তাদের চিঠি পাওয়ার পর বিভাগটি গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওনা হিসাব করেছে ২৬ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে। এ উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও ঋণের কারণে তারা ব্যাংকের কাছে দেনাদার থাকে। এদিকে বিপিডিবি যে দামে কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে, তার চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করে বাজারে। তবে কেনা দাম ও বাজার দামের পার্থক্য ভর্তুকি আকারে দেয় অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগ এ টাকা দিচ্ছিল না বলে কেন্দ্রগুলো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে তাদের অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছিল। টাকা দিতে না পারায় এখন অর্থ বিভাগ ব্যাংকগুলোকে সরাসরি বন্ড দিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকঋণের সমপরিমাণ অর্থের বন্ডই ছাড়বে অর্থ বিভাগ। সারের ক্ষেত্রেও একইভাবে বন্ড পাচ্ছে ব্যাংকগুলো।