ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে : আহসান এইচ মনসুরসাপ্তাহিক দর বৃদ্ধির শীর্ষে খান ব্রাদার্সদুই বিলিয়ন ডলারের নতুন সহায়তার প্রতিশ্রুতি বিশ্বব্যাংকের শেয়ারবাজারে দর পতনে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ বাংলাদেশের শিল্প খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী কাতার : শিল্পমন্ত্রী
No icon

চায়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় হতাশ বাগানের মালিকেরা

চা বেচাকেনা হয় চট্টগ্রাম ও সিলেটের নিলাম কেন্দ্রে। চট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্রে গত এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৬ কোটি ৯২ লাখ কেজি। গত মৌসুমের (২০২২–২৩) একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৭ কোটি ৩ লাখ কেজি।  নির্বাচনের মৌসুমে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। শীতকালে চায়ের চাহিদাও থাকে বেশি। চা বেচাকেনায় এমন ধারণা পাল্টে গেছে এবার। নির্বাচনের মৌসুমেও চায়ের বেচাকেনা বাড়েনি। উল্টো কমে গেছে চা বিক্রি। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার–প্রচারণা শুরু হয়েছিল গত ১৮ ডিসেম্বর। গত শুক্রবার এই প্রচারণা শেষ হয়। গতকাল ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ভোটের আগে টি স্টলে চা বেচাকেনা, নিলামে বিক্রির তথ্য ও কোম্পানিগুলোর বিক্রির হিসাবে চা বিক্রি কমে যাওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। 

চা বেচাকেনায় জড়িত নানা পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এবার নির্বাচন উৎসবমুখর ছিল না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে অনেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেলেও খুব একটা উৎসবমুখর ছিল না নির্বাচনের পরিবেশ। তাতে দিন শেষে চায়ের বেচাকেনাও বাড়েনি।  চা বেচাকেনা বাড়ছে নাকি কমছে, সেটির ধারণা পাওয়া যায় নিলাম কেন্দ্রে বেচাকেনার তথ্যে। কারণ, চা কোম্পানিগুলো মূলত নিলাম থেকেই চা সংগ্রহ করে বাজারজাত করে। চাহিদা বাড়লে তারা নিলাম থেকে চা সংগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। 

চা বেচাকেনা হয় চট্টগ্রাম ও সিলেটের নিলাম কেন্দ্রে। চট্টগ্রামের নিলাম কেন্দ্রে ৯৮ শতাংশ চা বিক্রি হয়। এই নিলাম কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, গত এপ্রিল থেকে চলতি মৌসুমের নিলাম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৩৫টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৬ কোটি ৯২ লাখ কেজি। গত মৌসুমের (২০২২–২৩) একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল সাত কোটি তিন লাখ কেজি। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে নিলামে ১০ লাখ ৮৭ হাজার কেজি চা বা ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ চা কম বিক্রি হয়েছে। 

নিলামে চা বিক্রি কমে যাওয়ার জন্য মূলত বাজারে চাহিদা কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে বলছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি নিলামেই বিপুল পরিমাণ চা বিক্রির জন্য তোলা হয়েছিল। কিন্তু বিক্রি হয়েছে ৫০ শতাংশ। যেমন চট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্রে ৩০ থেকে ৩৫তম নিলামের প্রতিটিতে চা বিক্রি কমেছে গড়ে ৫০ শতাংশ। এ সময়ে প্রতিটি নিলামে গড়ে ৪৫ লাখ কেজি চা বিক্রির জন্য তোলা হয়েছিল। প্রতি নিলামে গড়ে বিক্রি হয়েছে ২২ লাখ কেজি চা। 

নিলামে বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিটিএবি) চেয়ারম্যান ও ইস্পাহানি টি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চায়ের চাহিদা এখন কম। আবার উৎপাদন বাড়ায় চাহিদার তুলনায় জোগানও বেড়ে গেছে। এ কারণে গতবারের চেয়ে এবার একই সময়ে চা বিক্রি কমেছে।  চায়ের বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো বলছে, সবচেয়ে বেশি চা পান করা হয় রেস্তোরাঁ ও চায়ের স্টলে। দেশে মোট চা পানের ৫০-৫৫ শতাংশ হয় এই খাতে। এর বাইরে বাসাবাড়ি ও অফিসে চা পানের হার ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। 

বেচাকেনা কেমন চলছে তা জানতে কথা হয় চট্টগ্রামের আটটি চায়ের স্টলে। বিক্রেতারা বলছেন, ভোট উৎসবের সময় যেভাবে চায়ের চাহিদা বাড়ে; এবার তেমন দেখা যায়নি। কোনো দিন বিক্রি বেড়েছে, আবার কোনো দিন কমেছে। আবার লিকার চায়ে ঝুঁকেছেন অনেকে। তাতে চা–পাতার ব্যবহারও কমেছে।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে প্রগ্রেসিভ টাওয়ারের নিলাম কেন্দ্রের গলির মুখে নামহীন একটি চায়ের স্টলের পাশেই ছিল চট্টগ্রাম–১০ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প। নৌকা প্রতীকের মো. মহিউদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমের নির্বাচনী ক্যাম্পে গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার গুটিকয়েকের বেশি কর্মী–সমর্থক দেখা যায়নি সেখানে। চায়ের স্টল পরিচালনাকারী মো. আজিজ কথা প্রসঙ্গে জানান, ভোটের সময় বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা ছিল। তবে এবার তা হয়নি। 

এক বছরের বেশি সময় ধরে চায়ের চাহিদায় নিম্নমুখী প্রবণতা ছিল। যেমন ২০২১-২২ মৌসুমে (এপ্রিল–মার্চ) নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৯ কোটি ১৪ লাখ কেজি। ২০২২-২৩ মৌসুমে বিক্রি হয় ৮ কোটি ৮৭ লাখ কেজি চা। অর্থাৎ ২০২১-২২ মৌসুমের তুলনায় ২০২২–২৩ মৌসুমে নিলামে চা বিক্রি কমেছে ৩ শতাংশ। ২০২২–২৩ মৌসুম শেষ হয়েছে গত মার্চে। 

নতুন মৌসুমে জাতীয় নির্বাচন হলেও চা বিক্রি কমার এই ধারাবাহিকতা থেকে বের হওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবে চা বাজারজাতকারী ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনের পরিবেশ উৎসবমুখর ছিল না। অনেক আসনেই শক্ত প্রার্থী না থাকায় প্রচারণাও জমেনি। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে প্রচার–প্রচারণা জমে উঠত। চায়ের বিক্রিও বাড়ত।

চা বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো বলছে, নির্বাচনের আগেও চায়ের চাহিদা ছিল কম। চাহিদা কমার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন তাঁরা। এক. দুধ–চিনি মেশানো চায়ের চাহিদা বেশি থাকলেও এখন স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য অনেকেই লিকার চায়ে ঝুঁকছে। দুধ–চিনি মেশানো চায়ের তুলনায় লিকার চা তৈরিতে ৫০ শতাংশ চা–পাতা কম দরকার হয়। দুই. দুধ–চিনির দাম বাড়ায় প্রতি কাপ চায়ের দাম বেড়েছে। জীবনযাপনের খরচের চাপ সামলাতে মানুষ এখন আগের তুলনায় কম চা পান করছেন। নির্বাচনের সময়ও এই চাহিদা চাঙা হয়নি। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদনের রেকর্ড হতে যাচ্ছে। চা বোর্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত চা উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৫৩ লাখ কেজি। বছর শেষে তা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। চা উৎপাদন যখন বাড়ছে, তখন চায়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় হতাশ বাগানের মালিকেরা। কারণ, উৎপাদন বাড়ায় নিলামে চায়ের জোগান বেড়ে গেছে। তাতে নিলামে দাম পড়ে গেছে চায়ের। 

চট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ মৌসুমের ৩৫টি নিলাম পর্যন্ত চায়ের গড় দাম উঠেছে ১৮৭ টাকা। গত বছর একই সময়ে গড় দাম ছিল ২০২ টাকা। প্রতি কেজিতে গড়ে সাড়ে সাত টাকা দাম কমে গেছে।দেশে এখন চায়ের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেড়ে গেছে। এ কারণেই চায়ের দাম পড়ে গেছে। এটা এই শিল্পের জন্য বড় দুঃসংবাদ হয়ে আসছে।