আমদানি কমলেও কাটছে না ডলার সংকট। আর চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় এলসি খুলতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে পণ্য আমদানি কমার ধারা এবারও অব্যাহত আছে। গত অর্থবছর আমদানি প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশ। আর এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।
জানা গেছে, ডলার সংকট রোধে গত বছরের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু পণ্যে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নির্ধারণ এবং প্রতিটি এলসি ধরে ধরে যাচাই করা হচ্ছে। আবার কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়। ফলে গত বছরের জুলাই থেকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এলসি খোলা আরও কমার মানে হলো অর্থনীতিতে স্থবিরতা বাড়ছে। ডলার ও টাকার সংকটের পাশাপাশি নির্বাচনের বছর হওয়ায় এখন অনেকে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। কর্মসংস্থানমূলক বিনিয়োগ না এলে আগামীতে অর্থনীতি আরও স্থবির হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। নিষ্পত্তি হয় ৫৯৮ কোটি ডলারের। আগের বছরের একই মাসে যেখানে ৬৩৫ কোটি ডলারের এলসি খোলা এবং ৭৪৯ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে এলসি খোলা বেশি কমেছে পেট্রোলিয়াম পণ্যের। জুলাইতে মাত্র ৪৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। আগের অর্থবছরের একই মাসে এর পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ডলার। এলসি খোলা হ্রাসের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল। এই পণ্যের এলসি ৩৬ শতাংশের বেশি কমে ১৩৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এছাড়া শিল্পে ব্যবহৃত প্রাথমিক পণ্যের এলসি প্রায় ৩১ শতাংশ কমে ৩২ কোটি ডলার, মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি ২২ শতাংশ কমে ১৮ কোটি ডলার এবং ভোক্তাপণ্যের এলসি ২১ শতাংশ কমে ৪৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অন্যান্য পণ্যের এলসি ১৮ শতাংশ কমে খোলা হয় ১৪৯ কোটি ডলারের।
এদিকে গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে কোনো ব্যাংকের কাছে সস্তায় কিংবা স্বাভাবিক দরেও ডলার বিক্রি করা হবে না। কিন্তু গত ২৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখায় রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন, যা গত বছর একই সময়ে ছিল প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের ২৩ দিনে (১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। গত বছর একই সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭৭ কোটি ৮০ লাখ (১ দশমিক ৭৭ বিলয়ন) ডলার। আর বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের আমদানি বিল পরিশোধ বাবদ সোনালীসহ কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। এই রেট বাজারের তুলনায় সস্তা। বাজারে প্রতি ডলার ১১৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে অবৈধ চ্যানেলে ডলার লেনদেন হবে। এ জন্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ার পরেও ডলার সংকট সহসাই কাটছে না। এই ডলার পাচার হয় কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের জুলাইতে বিক্রি করা হয় ১১৪ কোটি ৭০ ডলার বা ১১৪৭ মিলিয়ন ডলার। আর চলতি মাস আগস্টের প্রথম ২৩ দিনে বিক্রি করা হয় ৮১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর আগে বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
অন্যদিকে গত বুধবার আইএমএফের হিসাবে, প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে, রিজার্ভ রয়েছে ২৯ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৯৩২ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল রিজার্ভ। পরের বছর ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে কমতে কমতে ২৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে, যা দেশের স্বার্থেই করা হয়। আর ডলার পর্যাপ্ত থাকায় বিক্রি হচ্ছে। রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে যে পরিমাণ ডলার রয়েছে তা দিয়ে ৫ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের রিজার্ভের অর্থ দিয়ে ৩ মাসের আমদানি মেটানোকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়।’