দর পতন রুখতে করণীয় নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বৈঠকের পরদিন ফের দর পতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। বৈঠকের খবরে গত সোমবার যেখানে প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে ১০৯ শেয়ারের দর পতনের বিপরীতে ২২১টির দর বেড়েছিল, গতকাল মঙ্গলবার সেখানে ৪৭ শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে ৩১০টিই দর হারিয়েছে। এতে প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৪১ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৬৩৩ পয়েন্টে নেমেছে। দর পতন রুখতে বিএসইসি কিছু একটা করবে– এমন আশা তৈরি হওয়ায় সোমবার বেশির ভাগ শেয়ারের দর বেড়েছিল। আগের বৈঠকের মতো সোমবারের বৈঠকটি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আহ্বান জানানো ছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ আসেনি। এতে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় অব্যাহত দর পতন রুখতে ব্যর্থতার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে দায়ী করে কিছু বিনিয়োগকারী গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পুরোনো ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে দাঁড়ানো বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, বর্তমান কমিশনের জন্য শেয়ারবাজারের আজকের এ দুরবস্থা। এ জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান পদে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে ফের নিয়োগ না দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনোভাব হলো, নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে দর পতন রুখতে পারে এবং দর পতন হলে তা রুখে দেওয়া এ সংস্থারই দায়িত্ব। যদিও শেয়ারদর বাড়ল, নাকি কমলো– তা শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেখার বিষয় নয়। অস্বাভাবিক কারণে বা কারসাজি করে শেয়ারবাজারে দর পতন উস্কে দিলে বা দর বাড়ালে তা এ সংস্থার দেখার বিষয়। বিশ্বের সব দেশের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এভাবেই কাজ করে।
ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে এর উল্টোটা ঘটে। দর পতন হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাই বেশি উদ্বিগ্ন হন। তারাই আগ বাড়িয়ে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ তৈরি করেন। তারাই ‘মিটিং-সিটিং’ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অযৌক্তিক ধারণা ও আশাবাদ তৈরি করেন।
সোমবার বিএসইসির বৈঠকে উপস্থিত অংশীজনের একজন সমকালকে বলেন, ২০১০ সালে ধসের পর দর পতন ঠেকাতে বিএসইসি গত এক যুগেরও বেশি সময়ে বহু বৈঠক করেছে। কিন্তু এসব বৈঠক কাজে আসেনি। বৈঠকে অংশ নেওয়া অপর শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দর পতন হলেই বিএসইসি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের, বিশেষত ব্রোকার ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিকে বিনিয়োগ বাড়াতে বলে। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন করে চাপও দেয়। এর চাপে পড়ে আগে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু বিনিয়োগও করেছে। তবে প্রতিবারই বিনিয়োগ করে লোকসান করেছে। এ কারণে বিএসইসির পক্ষ থেকে এখন এ ধরনের আহ্বানে কাজ হচ্ছে না। কেউ কেউ বিনিয়োগ করার আশ্বাসও দেয়, কিন্তু করে না। কারণ, এত টাকা কোথা থেকে পাবে।
সোমবার কাদের বিনিয়োগে শেয়ারদর বেড়েছিল– এমন প্রশ্নে অন্যতম প্রধান এক মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দর পতন মাত্রা ছাড়ালে বিএসইসির কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট কিছু ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে শেয়ার বিক্রির চাপ কমাতে বলেন। দর পতনের সময় হতাশ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি থাকলেও আশাবাদী কিছু বিনিয়োগকারী থাকেন, যারা মনে করেন আগামীকালই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। একদিকে বিক্রি চাপ কম থাকা, অন্যদিকে আশাবাদীদের ক্রয় চাপে দর পতন সাময়িক বন্ধ হয়। তবে ইতিহাস বলে, এ ধারা বেশিদিন স্থায়ী হচ্ছে না।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল-আমীন বলেন, শেয়ারবাজার এমন এক জায়গা, যেখানে কাউকে বিনিয়োগের জন্য ডেকে আনার প্রয়োজন হয় না। মানুষ যখন দেখে, এখানে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া যাবে, তখন নিজেরাই বিনিয়োগে আসে। আর যদি মনে করে, এ মুহূর্তে বিনিয়োগ করে লোকসান হবে, তবে টেনেও আনা যায় না।
বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. আল-আমীন বলেন, গত আড়াই মাসে মাত্রাতিরিক্ত দর পতন হয়েছে। অনেক শেয়ার তার যৌক্তিক দরের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা মন্দা থাকলেও পরিস্থিতি এত খারাপ নয়। তার পরও দর পতনের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং সার্বিক সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেন এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, কেউ না কেউ দর পতন ঠেকিয়ে দেবে। আদতে এই ঠেকিয়ে দেওয়ার নাম করে কারসাজি চক্র নিজেদের ফায়দা লুটছে, আর বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাচ্ছে।
লেনদেন সংক্ষেপ
সার্বিক দর পতনের মধ্যে গতকাল সব খাতেরই অধিকাংশ শেয়ার দর হারিয়েছে। তবে এর মধ্যে ১২ কোম্পানির শেয়ার ৩ থেকে প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশের ওপর দর বেড়েছে বিডি থাই ফুড, ওরিয়ন ইনফিউশনস, লাভেলো ও মালেক স্পিনিংয়ের।
বিপরীতে ৩ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১০৬ কোম্পানির শেয়ার। ৫ শতাংশের ওপর দর হারিয়েছে ২১টি। সর্বাধিক ৯ শতাংশ দর হারিয়ে অলিম্পিক অ্যাকসেসরিজ ছিল দর পতনের শীর্ষে।
এমন দর পতনের মধ্যে গতকাল লেনদেন বেড়েছে। ডিএসইতে লেনদেন ২২ কোটি ৬৪ লাখ বেড়ে ৫৯৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় উঠেছে। এ লেনদেন গত ২১ মার্চের পর সর্বোচ্চ।