ভবিষ্যতের জন্য ডলার বুকিং দেওয়ার নতুন নিয়ম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরোয়ার্ড রেট) সর্বোচ্চ কত হবে তা-ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এক বছর পর ডলারের দাম বর্তমানের চেয়ে ‘এসএমএআরটি’ বা স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি নিতে পারবে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক গত রবিবার এসংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে নতুন নিয়ম চালু করেছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ডলার সাশ্রয়ে আমদানি নিরুৎসাহ করা বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলতে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার ডলার বুকিংয়ের সময়সীমা বাড়িয়ে নতুন নিয়ম চালু করল। একই সঙ্গে বাজারে ডলারের জোগান বাড়াতে রপ্তানিকারকদের ডলার ধরে রাখার সীমা অর্ধেক কমানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলার ক্রয় ও বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ দাম নির্ধারণ করা যায়। কোনো আমদানিকারক এখনই ডলার কিনে এক বছরের মধ্যে পণ্য আমদানি করতে পারেন। এ জন্য তাঁকে বর্তমান ডলারের সঙ্গে ব্যাংককে বাড়তি কমিশন দিতে হয়। ওই সময়ে দাম কমে গেলেও আমদানিকারককে বর্তমান দাম দিতে হবে। আবার দাম বেড়ে গেলেও তিনি সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ বাড়তি দাম দিতে হবে না। এদিকে রপ্তানিকারকও নির্দিষ্ট সময়ে ডলার বিক্রি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দাম কমে গেলে রপ্তানিকারক লোকসানেও পড়তে পারেন। নতুন নিয়ম কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দেবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
কিভাবে আগাম বুকিং
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নতুন নিয়মে এক বছরের জন্য ডলার বুকিং দিয়ে রাখা যাবে। এ জন্য গ্রাহককে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। এটা নির্ধারিত হবে এখন যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয় সে হিসাবে, যেটা স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত, সংক্ষেপে যার নাম এসএমএআরটি।
প্রতি মাসের শুরুতে স্মার্ট রেট জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাইয়ে স্মার্ট রেট ছিল ৭.১০ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৭.১৪ শতাংশ, যা চলতি সেপ্টেম্বরেও অপরিবর্তিত রয়েছে। আগাম ডলারের দরের জন্য ‘এসএমএআরটি’ রেটের সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ যোগ করতে হবে। অর্থাৎ তা ১২.১৪ শতাংশ হবে। গতকাল থেকে আমদানিতে ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা কার্যকর হয়েছে। কেউ যদি ভবিষ্যতের জন্য ডলারের বুকিং দিতে চান, তাহলে তাঁকে এক বছর পর প্রতি ডলারে ১২৩ টাকার মতো পরিশোধ করতে হবে। আর মাসভিত্তিক দাম হলে তা মাস হিসাবেই কমে আসবে। আমদানিকারকদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রির জন্য বেসরকারি খাতের ১০ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নিয়মটি চালু করেছে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, ‘বাংলাদেশে ফরোয়ার্ড মার্কেট খুবই সংক্ষিপ্ত। তিন ও ছয় মাসের আছে, এক বছরের ছিল না। একজন ব্যবসায়ী এলসি খোলার তিন মাস পর সেটলমেন্ট হবে। তখন ডলারের দাম কী হবে তা তাঁরা জানেন না। এখন জানা থাকলে সুবিধা হবে। যে ব্যবসায়ী দরকার মনে করবেন তিনি নেবেন, যিনি মনে করবেন না তিনি নেবেন না। তবে এটার দরকার আছে।’ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি বেশি, রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এতে আগামী দিনে ডলারের ওপর চাপ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
‘ডলারের মূল্য নির্ধারণে যে ফরোয়ার্ড রেট চালু করা হয়েছে তা ঘোষিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সরকার জুনে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বলেছিল তারা ডলারের মূল্য বাজারভিত্তিক করবে, কিন্তু তো তা করলই না বরং ভবিষ্যতের ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে দিল। এতে বাজার পরিস্থিতি আরো উসকে যাবে। নতুন করে ফরোয়ার্ড ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় কোনো লাভ আপাতত দেখছি না বরং এতে কিছু ব্যাবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে।
আরেক দফা বাড়ল ডলারের দর
আবারও ডলারের দর বাড়িয়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। এবার সব ক্ষেত্রেই ৫০ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে। তাতে এখন থেকে রপ্তানি ও প্রবাস আয়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা, আর আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। গত রবিবার বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে ডলারের এই নতুন দর নির্ধারিত হয়। গতকাল থেকে তা কার্যকর হয়েছে। এর আগে ৩১ আগস্ট ডলারের দর বাড়ানো হয়। সেবার পণ্য বা সেবা রপ্তানি ও প্রবাস আয় কেনায় ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, আমদানির জন্য নির্ধারণ করা হয় ১১০ টাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট বাড়তে থাকে। সংকট মোকাবেলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরো বেড়ে যায়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এর পর থেকেই সংগঠন দুটি মিলে রপ্তানি ও প্রবাস আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১৮ টাকা পর্যন্ত।
আন্ত ব্যাংক মার্কেটে সংকট কাটাতে ও প্রবাহ বাড়াতে রপ্তানিকারকদের ডলার ধরে রাখার সীমা ৫০ শতাংশ কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এত দিন পণ্য রপ্তানিকারকরা তাঁদের প্রত্যাবর্তিত রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারতেন। এখন থেকে তাঁরা ৩০ শতাংশ অর্থ ধরে রাখতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে, রপ্তানিকারকরা তাঁদের প্রত্যাবর্তিত রপ্তানি আয়ের একটি অংশ ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে রাখতে পারেন। সে অর্থ দিয়ে তাঁরা কাঁচামাল ক্রয় ও আমদানির অর্থ প্রদান করতে পারেন।
ন্যাপথা, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিন, আমদানীকৃত কাপড় দিয়ে বানানো তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক পণ্য এবং আরো অনেক কিছুর জন্য রপ্তানি আয় ধরে রাখার পরিমাণ আগের ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া আইটি সেক্টরের বেলায় এই সীমা ৩৫ শতাংশ রাখা হয়েছে, যা এত দিন ছিল ৭০ শতাংশ। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, রেমিট্যান্স আয় ও প্রবাসীদের রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, যার কারণে মার্কেটে ডলারের প্রবাহ কমে এসেছে। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।